একজন সিকিউরিটি গার্ড এসে যাত্রীদের বের করে দিলেন। যাত্রী ছাউনি ছাড়া অন্য কোথাও এ সময় কেউ অবস্থান করতে পারেন না। বুখারেস্টে তেমনটি হয়নি। রোমা নামক এক স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক মানুষ রয়েছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে। তারা সাধারণভাবে জিপসি বা যাযাবর নামে পরিচিত; দেখতে গতানুগতিক ইউরোপিয়ানদের মতো নয়।
তাদের গায়ের চামড়া কিছুটা গাঢ় বর্ণের হয়ে থাকে। শারীরিক গড়নের দিক থেকে আমাদের এ উপমহাদেশের মানুষদের সঙ্গে তাদের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। রোমা জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তাদের চালচলনের ভঙ্গিও ইউরোপিয়ানদের থেকে আলাদা।
তুলনামূলকভাবে তারা অনেকটা অপরিষ্কার। অনেকে বলে রোমা জনগোষ্ঠীর এ সকল অধিবাসীদের পূর্ব পুরুষরা নাকি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন। পরে তারা ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হয়ে যান।
রোমা জাতিগোষ্ঠীর এ সকল মানুষেরা অনেক সময় বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হন। মূল যারা শ্বেতাঙ্গ রয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা এদের সঙ্গে সহজে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এ কারণে রোমা জাতিগোষ্ঠীর এ সকল মানুষের আচরণে রুক্ষতা ফুঁটে ওঠে, এরা অনেকটা কুঁড়ে স্বভাবের।
ইউরোপের রাস্তাঘাটে আমরা ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাদেরকে খুঁজে পাই তাদের বেশিরভাগই এ রোমা সম্প্রদায়ের মানুষ। শিক্ষাক্ষেত্রেও তারা অনেক পশ্চাৎপদ। ইউরোপের সাধারণ মানুষদের অনেকে মনে করেন এরা ছোটখাট চুরি থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত।
বুখারেস্টের বাস স্টেশনে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে শুধু তাদের অস্তিত্ব চোখে ধরা দিলো। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই দৌড়ে পালায়। ইউরোপে আসার পর থেকে রোমা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি। রোমানিয়া সম্পর্কেও অনেকে বাজে মন্তব্য করেছে।
ভোরে মিলিটারি আটোগারার বাস স্টেশনে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা আঁতকে উঠলাম। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ইতালি, সার্বিয়াসহ ইউরোপের অনেক জায়গায় বেশ কয়েকবার রোমা জাতিগোষ্ঠীর কিছু মানুষের সঙ্গে আমার বাজে এক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বুলগেরিয়াতেও সেটার ব্যতিক্রম হয়নি।
স্বভাবতঃ সে খারাপ অভিজ্ঞতার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আচমকাই মিলিটারি অটোগারা থেকে সকলে যেনও হাওয়ায় মিশে গেল, আমি একা বসে আছি তখন বলতে গেলে বাস স্টেশনে একা। আশপাশে কেউ নেই, কোনও কিছু খোয়া যায় কি না এ ভয়ে চোখের পাতা এক করতে পারছি না।
সকাল ছয়টার দিকে এক ভদ্রলোক এসে স্টেশনের ভেতরের ইনফরমেশন অফিস খুললেন; কিছুক্ষণ পর এক মাঝ বয়সী নারী আসলেন আমার কাছে। আমাকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘‘Where are you from?’’ আমি বললাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
তিনি বললেন, ইংরেজিতে তার দক্ষতা খুব একটা বেশি ভালো না। তারপরেও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি বললেন যে তিনি ট্রান্সসিল্ভানিয়া থেকে এসেছেন এবং সেখানে ফিরে যাবেন। আমি তাকে বললাম যে দীর্ঘদিন স্লোভেনিয়াতে থাকার সুবাদে সেখানে বসবাস করা অনেক হাঙ্গেরিয়ানের কাছে শুনেছি যে ট্রান্সসিলভানিয়া প্রকৃতপক্ষে হাঙ্গেরির অংশ কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ট্রান্সসিল্ভানিয়াকে হাঙ্গেরির থেকে নিয়ে রোমানিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তার কাছে আমি এ দাবির সত্যতা জানতে চাইলাম। তিনি আমার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর দিলেন যে এ কথাটি আসলে সত্য নয়। এরপর তিনি আমাকে তার সঙ্গে ট্রান্সসিলভানিয়াতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমাকে তিনি বললেন যে যদি আমি ট্রান্সসিলভানিয়াতে যাই তিনি আমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবেন।
সে মুহূর্তে আমার ট্রান্সসিলভানিয়া ঘোরার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তবে তাকে আমি বলি কোনো ট্রান্সসিলভানিয়াতে গেলে অবশ্যই দেখা করবো তার সঙ্গে। তিনি আমাকে তার ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা দিয়ে বললেন ‘GOOD BYE! Have a nice trip to Bucharest and you are welcome in Transylvania too.’ অতঃপর আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম; আমার মোবাইল ফোনে চার্জ ছিল না।